ধান উৎপাদনে খরচ কমানোর উপায়
কৃষি উৎপাদনে আমাদের দেশের অনেক অর্জন রয়েছে। স্বাধীনতার আগে দেশের জনসংখ্যা সাড়ে সাত কোটি বা তার বেশি হবে। তখন দানা শস্যের উৎপাদন ১ কোটি টন থেকে ১ কোটি ১৭ লাখ টন কম ছিল। খাদ্যশস্যের মধ্যে ধান ছিল প্রধান ফসল। অল্প পরিমাণ জমিতে গমের চাষ হতো। এখন আমরা ধান, গম, ভুট্টা চাষ করে প্রায় ৪ কোটি টন উৎপাদন করতে পারছি। এদেশের কৃষকরা প্রায় চারগুণ দানাদার ফসল উৎপাদন করেছে।
বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা এবং জনসংখ্যা প্রতি বছর ২০ থেকে আড়াই কোটিতে বাড়ছে। বর্তমান সরকারের নিরলস প্রচেষ্টায় ধান উৎপাদনে বিশতম স্থান দখল করেছে। তা অর্জনের পরও আমাদের ধান চাষিদের ধানের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। যে কারণে ধানের উৎপাদন খরচ কমানো আজ আলোচনার বিষয়। ধান উৎপাদনে বীজ নির্বাচন, জমির ধরন, স্থানীয় জলবায়ু, ধানের আয়ুষ্কাল, ধানের ফলনের লক্ষ্যমাত্রা (লক্ষ্য মাত্রা) বিবেচনায় নিয়ে খরচ কমানো সম্ভব।
স্থানীয় ডিলারদের কাছ থেকে কেনার সময় বীজের দাম, বীজের অঙ্কুরোদগম হার এবং হেক্টর প্রতি ফলন অবশ্যই ধানের বীজের ব্যাগে উল্লেখ করতে হবে। ক্রয় রশিদে বীজের দাম উল্লেখ করতে হবে। BADC বীজ ট্যাগ করা আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
বীজ শোধন করা
বীজ শোধন বীজের উপর রোগের আক্রমণ কমায়। চারা সুস্থ, শক্তিশালী। প্রতি কেজি ধানের বীজে ১ গ্রাম হারে বীজ শোধন বা তুঁতের গুঁড়া দিয়ে বীজ শোধন করা যেতে পারে।
বীজতলার যত্ন: বীজতলা ভালোভাবে চাষ করতে হবে, পৃষ্ঠতল হতে হবে। দুটি বীজতলার মধ্যে একটি ড্রেন বা ড্রেন স্থাপন করা বীজতলার সেচের সুবিধা দেয় এবং অতিরিক্ত জল নিষ্কাশনের অনুমতি দেয়।
একটি আদর্শ বীজতলার জন্য ১০-১৫% কম বীজের প্রয়োজন হয়। এতে উৎপাদন খরচ কমে যায়।
চারার বয়স নির্ধারণ করা
চারার বয়স ঋতু, ধানের বৈশিষ্টের উপর নির্ভর করে। পুরানো চারা রোপণ করবেন না। আমন মৌসুমে ২০-২৫ দিন, বোরো মৌসুমে ২৫ থেকে ৩০ দিন নির্বাচন করতে হয়।
চারার সংখ্যা: প্রতি গর্তে ২টি সুস্থ চারা, প্রতি চারা মৌসুমে ২টি। গর্তে বেশি চারা লাগালে ফলন বাড়ে না। এ কারণে চারার সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করে উৎপাদন খরচ কমানো যায়।
রোপণের দূরত্ব নির্ধারণ করা
ধানের চারা রোপণের দূরত্ব ঋতু, বৈচিত্র্যের বৈশিষ্ট্য এবং জীবনকালের উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করতে হয়। সারি থেকে সারিতে ২৫ সেমি এবং গাছ থেকে গাছে ২০ সেমি দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। সঠিক দূরত্বে চারা রোপণ করলে চারার সংখ্যা কম হয়। এতে পশুখাদ্যের খরচ কমে যায়।
সার প্রয়োগ পদ্ধতি অবলম্বন করা
সার হল উদ্ভিদের খাদ্য। গাছপালা তাদের শিকড়ের মাধ্যমে মাটি থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে। মাটি ভালোভাবে তৈরি হলে শিকড় সহজেই মাটি থেকে খাদ্য গ্রহণ করতে পারে। ধান ফসলে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ইউরিয়া সার ব্যবহার করা হয়। ধান ক্ষেতে সার প্রয়োগের সময় মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকতে হবে। ধানের চারা রোপণের ১০ থেকে ১২ দিন পর প্রথম ইউরিয়া প্রয়োগ করা ভালো। ওই সময় মাটিতে ২ ইঞ্চি পানি ছিটিয়ে দিলে ভালো হয়। সূক্ষ্ম ইউরিয়া সার ব্যবহার করলে সারের কার্যক্ষমতা বাড়ে, ফলন বাড়ে। ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কম পরিমাণে ইউরিয়া সার প্রয়োজন। এতে সারের খরচ অনেক কমে যায়।
খরচ কমাতে সেচ ব্যবস্থাপনা করা
খরচ কমাতে ধানের জীবনকাল অনুযায়ী সঠিকভাবে সেচ প্রয়োগ করতে হবে। সম্ভব হলে পর্যায়ক্রমে মাটি ভিজিয়ে রাখা ভালো (কাঁচি বের হওয়ার আগে)। বীজতলা তৈরির সময় বীজ বপনের পর শুকিয়ে গেলে ২ বার। ১ বার মাটি কাদা। রোপণের সময় প্রায় ৭.৫ সেমি। জল প্রয়োজন. সেক্ষেত্রে ৪-৫ বার সেচ দেওয়া যেতে পারে। রোপণ থেকে অঙ্কুরোদগমের আগে পর্যন্ত ৫-৭.৫ সেমি. জল প্রয়োজন. ফসলে সার প্রয়োগের সময় পানি অপসারণ করতে হবে। সার প্রয়োগের ২-৩ দিন পর আবার ৭-৮ বার পানি দিতে হবে।
তবে ধানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হল ফুল ও দুধ পর্যায়। বোরো ধান/রোপা আমন ধান ক্ষেতে ফুল ফোটার সময় কমপক্ষে ২ ইঞ্চি থেকে ৪ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে। বিকেলে সেচ দিলে পানির বাষ্পীভবন কমে যায়। মাটির গর্ত বা ফাটল বন্ধ করতে হবে। জমির আইল বজায় রাখতে হবে। রোপণ মৌসুমে অতিরিক্ত বর্ষার পানি নিষ্কাশন করতে হবে।
পোকামাকড় এবং রোগের আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষা করা
ধানের ফসল উৎপাদনে রোগ ও পোকার আক্রমণে উৎপাদন খরচের প্রায় ১৫ থেকে ২০% খরচ হয়। ধানক্ষেত থেকে ২০০ থেকে ৩০০ মিটার দূরত্বে আলোক ফাঁদের ব্যবস্থা করতে হবে। পাতায় মোড়ানো পোকা যেমন সবুজ শাক, ম্যাগট আলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। ধান ক্ষেতে পার্চিং বা ডাল পুঁতে দিতে হবে। পোকামাকড়কে হাতের জাল দিয়ে ধরে মেরে ফেলতে হবে।
লোগো পদ্ধতিতে ধানের চারা রোপণ করতে হবে। এতে ধানক্ষেতে আলো-বাতাস প্রবাহিত হবে। বাদামি পঙ্গপালের আক্রমণ কম হবে। যদি সেখানে বাদামী ফড়িং আক্রমণের সময় ধান ক্ষেতে পানি থাকে, তা নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নিন। এ সময় ইউরিয়া সার প্রয়োগ বন্ধ করুন। কীটনাশক প্রয়োগের সময় গাছের গোড়ায় কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। মাটির আইলে কিছু খড় রাখলে কাটাকৃমি এখানে আশ্রয় নেয়।
ধান কাটার পর সম্ভব হলে ধানের খড় পুড়িয়ে ফেলুন। বীজ কাটা শুঁয়োপোকা গাছে উঠে বীজ কেটে ফেলে। সম্ভব হলে বাঁশ দিয়ে ধান ঢেকে দিন। ধান ক্ষেতে পুঁচকে দেখা দিলে ক্ষেতের পানি শুকিয়ে দিন। জমিতে পানি না থাকলে পোকামাকড় পানি ছাড়া বাঁচতে পারে না।
ধানের রোগ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা করা
রোগ প্রতিরোধী জাতের ধানের ব্যবহার বাড়াতে হবে। অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ থেকে বিরত থাকতে হবে। ঝড়ের পরে নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করা উচিত নয়। ফসল তোলার পর জমি পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
ব্লাস্ট রোগ হলে প্রতি বিঘায় ৫ কেজি পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে (৩৩ শতাংশ)। ব্লাস্ট প্রতিরোধী ধানের জাত BR ২৮, BR১৬ ব্যবহার করতে হবে। এ রোগ দেখা দিলে জমিতে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। ধান ক্ষেতে নাইট্রোজেন ও পটাশ সারের ঘাটতি আছে হ্যাঁ, সেই সব জমিতে ব্রাউন স্পট রোগ দেখা যায়। সে কারণে দাগযুক্ত ধানের বীজ ব্যবহার করা যাবে না। স্বাস্থ্যকর বীজ ব্যবহার করুন। ইউরিয়া এবং পটাসিয়াম গ্রহণযোগ্য পরিমাণে মাটিতে প্রয়োগ করুন। খোসা পচে গেলে রোগ সহনশীল জাত যেমন Bri Dhan৩৮, Bri Dhan৪০, Bri Dhan৪১ ব্যবহার করতে হবে।
উফরা রোগ একটি নেমাটোড রোগ। ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষেতের পানি অন্য ক্ষেতে দেওয়া যাবে না। জমিতে ফসল তোলার পর, অন্যান্য ফসল লাগানোর আগে জমিতে ১৫ থেকে ২০ দিন লাঙল দিতে হবে।
ধান ক্ষেতে আগাছার উপদ্রব নিচু জমিতে প্রায় ৩০ থেকে ৪০% পর্যন্ত ফলন কমিয়ে দিতে পারে। আগাছামুক্ত ধানের বীজ ব্যবহার করতে হবে, কৃষি যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করে ব্যবহার করতে হবে, আইল, সেচের খাল পরিষ্কার রাখতে হবে। আধা পচা গোবর সার ব্যবহার করবেন না। সার প্রয়োগের সাথে সাথে হাত দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করা যায়।
ধানক্ষেতে চারা লাগানোর পর কয়েকদিন পানি দিলে আগাছা কমে যায়। ফুল ফোটার বা পরিপক্ক হওয়ার আগেই আগাছা তুলে ফেলতে হবে।
উপরোক্ত ব্যবস্থাগুলো বাস্তবায়িত হলে ধান উৎপাদন খরচ অনেক কম হবে। .....কৃষিবিদ অসিত কুমার সাহা
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url