গীবতের ভয়াবহতা-কোরআন ও হাদিসের আলোকে
গীবত হচ্ছে একটি ভয়ংকর গুনাহের কাজ। আমরা প্রায় গীবত এ জড়িয়ে পড়ি। অথচ গীবত কে মহান আল্লাহ তা'আলা মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। আজ আমরা কুরআন ও হাদিসের আলোকে গীবত সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো, ইনশাআল্লাহ।
গীবত কি
গীবত শব্দের অর্থ হচ্ছে অন্যের দোষ ত্রুটি আলোচনা-সমালোচনা করা,পরনিন্দা করা,পরচর্চা করা। অন্যের অনুপস্থিতিতে তার দোষত্রুটি আলোচনা-সমালোচনা করাই হচ্ছে গীবত। যদিও সেই দোষ ত্রুটি তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে। তবুও তা ইসলামী শরীয়তে চরমভাবে নিষিদ্ধ এবং কবিরা গুনাহ।
আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
"তিনি বলেন হে আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ! গীবত কি ? তিনি বললেন, তোমরা ভাইয়ের প্রসঙ্গে তোমার এমন ধরনের কথা-বার্তা বলা যা সে অপছন্দ করে। প্রশ্নকারী বলল, আমি যে কথাগুলো বলি তা প্রকৃতপক্ষেই তার মধ্যে নিহিত থাকলে, এক্ষেত্রে আপনার কি মত? তিনি বললেনঃ তুমি যে কথাগুলো বল তা প্রকৃতই তার মধ্যে নিহিত থাকলে তবেই তো তুমি তার গীবত করলে। তুমি যা বল তার মধ্যে যদি সেগুলো না থাকে তাহলে তুমি তাকে মিথ্যা অপবাদ দিলে।"
[আত-তিরমিজি- হাদিস নং ১৯৩৪]
গীবতের প্রকারভেদ-
অন্যের শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে খোটা/আলোচনা
আমরা প্রায় বলে থাকি, সে তো মোটা খাঁটো নাকটা বোকা, চুলটা কোকড়ানো দাঁতগুলো কত বড় বড় ইত্যাদি। এসব আলোচনা গীবতের অন্তর্ভুক্ত। অন্যের শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাসি ঠাট্টা করলে করলে নিশ্চয় তা ঐ ব্যক্তির ভালো লাগবে না। সে অনেক কষ্ট পাবে। অথচ আমরা সবাই কিন্তু এক আল্লাহর সৃষ্টি। আমরা কেউ আমাদের আকৃতি তৈরি করি নাই; আমাদের আকৃতদানকারী মহান আল্লাহ তা'আলা। কারো শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাসি ঠাট্টা বিদ্রুপ করলে গীবতের পাশাপাশি আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে ব্যঙ্গ করা হয়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিষেধ করেছেন অন্যের শারীরিক বৈশিষ্ট্য/গঠন নিয়ে আলোচনা না করতে।
একদিন আম্মাজান মা আয়েশা নবী করীম (সাঃ) কে বলেন"আপনি কি সাফিয়ার বেঁটে হওয়াকে অপছন্দ করেন না?? আল্লাহর রাসূল বললেন"হে,আয়েশা তুমি এমন এক কথা বললে যা নদীর পানিতে নিক্ষেপ করলে তার উপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করত"
সুতরাং, আমাদের অন্যের দৈহিক গীবত থেকে বেঁচে থাকতে হবে।
পোশাকের গীবত
আমরা অনেকেই অন্যের পোশাক দেখে নাক ছিটকিয়ে বিদ্রুপ করি। বলে থাকি এ পোশাক পরে তাকে জোকার লাগছে, ইবলিশের মত লাগছে, ভিলেনের মত লাগছে,দেখ ঐ কিপটা কিরকম পোশাক পরেছে ইত্যাদি বাক্য ব্যবহার করি। এসব কথাবার্তা বলাও গীবতের অন্তর্ভুক্ত। আমাদের মাথায় রাখতে হবে সবার রুচিবোধ, সামর্থ্য একই রকম না। আপনার পছন্দই যে সেরা এমন ও না।
হাদিসে এসেছে,একদিন আম্মাজান আয়েশা বললেন"অমুক স্ত্রীলোকের আঁচল অনেক লম্বা। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম তৎক্ষণাৎ বললেন এ আয়েশা তুমি তার গীবত করলে। তোমার এখন থুতু ফেলা কর্তব্য।"
খাবারের খাওয়ার গীবত
কেউ খাবার বেশি খেলে তার সমালোচনা করা, কটাক্ষ করা, তাকে নিয়ে মজা করা ইত্যাদি গীবত এর অন্তর্ভুক্ত।দেখ, সে পেটুকের মতো খায়, সে তো দুই তিন জনের সমান খাবার খায়, সে কি মানুষ এত খাবার কিভাবে খায় ইত্যাদি কথা আমরা প্রায় বলে থাকি অথচ আমরা নিজের অজান্তেই হাসি ঠাট্টার ছলে এভাবে গীবত করে ঈমান,আমল সব হারাচ্ছি।।
গুনাহের গীবত
অমুক তো সুদখোর,ঘুষখোর, নামাজ পড়ে না, রোজা করে না, আত্মীয়র সাথে ঝামেলা হয়েছে এই ধরনের কথাবার্তা ও গীবতের অন্তর্ভুক্ত। অন্যের পাপ নিয়ে পরনিন্দা করা, সমালোচনা করার অধিকার আমাদের নেই। ঐ গুলো যেমন পাপ, তার থেকেও বড় পাপ হচ্ছে গীবত করা। সে তার পাপের জন্য আল্লাহর কাছে তওবা করলে মাফ পেয়ে যাবেন, ইনশাআল্লাহ।কিন্তু আপনি আপনার গীবতের জন্য আল্লাহর কাছে তওবা করলে তার কোন মাফ হবে না।
এছাড়াও, কারো হাঁটাচলা, কথাবার্তা, আমল,রান্না ইত্যাদি নিয়ে সমালোচনা করাও গীবত এর অন্তর্ভুক্ত।
কোরআন ও হাদীসের আলোকে গীবত
গীবত হচ্ছে একটি ভয়ংকর কবিরা গুনাহ। অন্যান্য যেকোনো কবিরা গুনার থেকে গীবত বেশি ভয়ংকর। গীবতের সাথে বান্দার হক সম্পর্কিত। আল্লাহ এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর কাছে গীবত ঘৃণিত একটি কাজ।
'¹. আল কোরআনে আল্লাহ তা'আলা বলেন"
يا أَيُّهَا الَّذينَ آمَنُوا اجتَنِبوا كَثيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعضَ الظَّنِّ إِثمٌ وَلا تَجَسَّسوا وَلا يَغتَب بَعضُكُم بَعضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُم أَن يَأكُلَ لَحمَ أَخيهِ مَيتًا فَكَرِهتُموهُ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ تَوّابٌ رَحيمٌ
অর্থ: মুমিনগণ, তোমরা অধিক অনুমান থেকে দূরে থাক। নিশ্চয় কোন কোন অনুমান তো পাপ। আর তোমরা গোপন বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের গীবত করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশ্ত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো তা অপছন্দই করে থাক। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ অধিক তাওবা কবূলকারী, অসীম দয়ালু।
[আল হুজরাত-৪৯:১২]
আল্লাহ সুবহানাতায়ালা আরও বলেন"
" وَيلٌ لِكُلِّ هُمَزَةٍ لُمَزَةٍ "
অর্থ: দুর্ভোগ প্রত্যেকের যে সামনে নিন্দাকারী ও পেছনে গীবতকারী।
[সূরা আল হুমাজাহ:০১]
². আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহি ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ মি’রাজের রাতে আমি এমন এক কওমের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলাম যাদের নখগুলো তামার তৈরী এবং তা দিয়ে তারা অনবরত তাদের মুখমণ্ডলে ও বুকে আচড় মারছে। আমি বললাম, হে জিবরীল ! এরা কারা? তিনি বললেন, এরা সেসব লোক যারা মানুষের গোশত খেতো (গীবত করতো) এবং তাদের মানসম্মানে আঘাত হানতো ।
[সুনানে আবু দাউদ-৪৮৭৮]
³.আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন,"তোমরা কি জান গীবত কি ’? তাঁরা বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল অধিক জানেন। তিনি বললেন, ‘তোমার কোন ভাই সম্পর্কে এমন কথা বল, যা সে অপছন্দ করে’। জিজ্ঞেস করা হল, আমি যা বলি যদি তা আমার ভাইয়ের মধ্যে বিদ্যমান থাকে, তাহলে আপনার কি অভিমত? তখন তিনি বললেন, ‘তুমি যা বল তার মধ্যে তা থাকলে তুমি তার গীবত করলে। আর যদি তার মধ্যে তা না থাকে যা তুমি বল, তখন তুমি তার প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করলে"
[মুসলিম, বাংলা মিশকাত-৪৬১৭)]
⁴.আবূ বারযাহ আল-আসলামী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেনঃ "হে সেসব লোক যারা কেবল মুখেই ঈমান এনেছে,কিন্তু ঈমান অন্তরে প্রবেশ করেনি ! তোমরা মুসলিমদের গীবত করবে না ও দোষত্রুটি তালাশ করবে না। কারণ, যারা তাদের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়াবে আল্লাহও তাদের দোষত্রুটি খুঁজবেন। আর আল্লাহ কারো দোষত্রুটি তালাশ করলে তাকে তার ঘরের মধ্যেই অপদস্থ করে ছাড়বেন।"
[সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং- ৪৮৮০]
গীবতের শাস্তি
আল কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন"নিশ্চয় আল্লাহর পাকড়াও বড় কঠিন"
আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল এর কাছে যা অপছন্দনীয়,যা আমাকে করতে নিষেধ করেছেন আমরা করি তাহলে তার জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি। মনে রাখতে হবে, আল্লাহ স্যার দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না। তুমি আমাকে তিনি আমাদের সৃষ্টিকর্তা। তুমি আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তার কাছে আমাদের ফিরে যেতে হবে। এবং আমাদের নিষিদ্ধ কৃতকর্মের জন্য রয়েছে শাস্তির বিধান। নিশ্চয়ই গীবত, সুদ ঘুষ যে না ব্যাভিচারের থেকেও ভয়ংকর। আর এই ভয়ংকর পাপের জন্য রয়েছে ভয়ংকর শাস্তি।
⁵.আবূ বাক্রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, "নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দু’টি ক্ববর অতিক্রম অতিক্রম করার সময় বলেন, নিশ্চয়ই এই দু’ক্ববরবাসীকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে এবং তাদেরকে কোন কঠিন অপরাধের জন্য শাস্তি দেওয়া হচ্ছেনা। এদের একজনকে পেশাবের (অসতর্কতার) কারণে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে এবং অপরজনকে গীবত করার কারণে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।"
[সুনানে ইবনে মাজাহ]
⁶.আল-মুসতাওরিদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহি ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ "যে ব্যক্তি অপর মুসলিমের গীবত করে এক লোকমা ভক্ষন করবে আল্লাহ তাকে এজন্য জাহান্নাম হতে সমপরিমাণ ভক্ষন করাবেন। আর যে ব্যক্তি অপর মুসলিমের দোষত্রুটি বর্ণনার পোশাক পরবে আল্লাহ তাকে অনুরূপ জাহান্নামের পোশাক পরাবেন। আর যে ব্যক্তি অপর ব্যক্তির (কুৎসা) রটিয়ে খ্যাতি ও প্রদর্শনীর স্তরে পৌছবে, মহান আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তাকে ঐ খ্যাতি ও প্রদর্শনীর জায়গাতেই (জাহান্নামে) স্থান দিবেন।
[সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৪৮৮১]
হাদিস ও কুরআনের আলোকে আমরা জানতে পারলাম গীবতকারীদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তির ব্যবস্থা। আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল গিবত থেকে আমাদের বাঁচার জন্য আমাদের বারবার সতর্ক করেছেন। আমরা একসাথে বসে আড্ডা দেওয়ার সময় হাসতে হাসতে গীবত করি। অথচ আমরা একবারও এ কথা ভাবি না যে আমাদেরের সাময়িক আনন্দ মৃত্যুর পর আমাদের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। হাসতে হাসতে আজ আমরা যে গীবত করছি কাল আমাদের এই কর্মফল আমাদের কাঁদতে কাঁদতে জাহান্নামে নিয়ে যাবে। তাছাড়া, গীবতকে মৃত ভাইয়ের গোশত তুলনা করা হয়েছে। একবার ভেবে দেখুন প্রিয় ভাই/বোন আমার এটা কত বড় একটা জঘন্যতম পাপ;অন্য কোন কিছু সে তুলনা না করে আল্লাহ সুবহানুতায়ালা মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। কিন্তু, আফসোস, আমরা মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে না চাইলেও গীবত ঠিকই করি। হাসি ঠাট্টা, অন্যকে ছোট করার জন্য আমরা নিজেদের পরকাল নষ্ট করছি। একবার ভেবে দেখছি না, আমরা কি পাচ্ছি, আর কি হারাচ্ছি।
লেখকের কিছু কথা
আমার প্রিয় ভাই/বোন, উপরের আর্টিকেল টি পড়ে আমরা জানতে পেরেছি যে গীবত কত বড় ভয়ঙ্কর একটি গুনাহ। আমরা চলতে ফিরতে, চা এর আড্ডায় প্রায় অন্যের সমালোচনা করে থাকি। এতে আমাদের পরকালীন কোন লাভ হয় না। ফুটো কলসিতে যেমন পানি থাকে না তেমনি গীবতকারির আমল জমা থাকে না। ফলে আমরা আমাদের আমল হারায়, পরকাল হারায়। আমরা আমাদের মৃত ভাইয়ের মাংস খেতে অপছন্দ করি, তাহলে কেন আমরা গীবত করি? আল্লাহর হক নষ্ট করলে তওবার মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করে দেন, কিন্তু তওবা করলে ও বান্দার হক নষ্ট করলে তা কখনোই ক্ষমা করেন না। গীবত এর ফলে বান্দার হক নষ্ট হয়। সুতরাং, প্রিয় ভাই /বোন আমার আসুন আমরা পরনিন্দা,পরচর্চা, অন্যের সমালোচনা না করি। নিজেকে পরিপূর্ণ মুমিন বান্দা হিসেবে গড়ে তুলি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেদায়েত দান করুক,আমিন।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url