নিজের চিন্তাকে পরিবর্তন করুন
আমাদের মনে সব সময় আজেবাজে খারাপ চিন্তা ঘোরাফেরা করে। আমরা না চাইলেও অনেক সময় অটোমেটিক চলে আসে। আজ আমরা, গৌতম বুদ্ধের একটি ঘটনার মাধ্যমে জানবো কিভাবে খারাপ চিন্তা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
গৌতম বুদ্ধের শিক্ষনীয় গল্প
একজন রাজা গৌতম বুদ্ধের আশ্রমে সন্ন্যাসী বা ভিক্ষুক হয়েছিলেন। সন্ন্যাসী হলে সাধারণত খাবারের জন্য ভিক্ষা করতে যেতে হয়। তাই, রাজা সন্ন্যাসী হওয়ার পর খাবারের জন্য প্রথম দিন যখন ভিক্ষা করতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন গৌতম বুদ্ধ রাজাকে যেতে নিষেধ করলেন। তিনি বলেন,"তুমি ভিক্ষা করতে যেও না, তুমি ভিক্ষা করা সম্পর্কে কিছুই জানো না। গতকাল পর্যন্ত তুমি একজন রাজা ছিলে আর আজকে একজন সন্ন্যাসী। আমি বুঝতে পারছি তোমার পক্ষে ভিক্ষা করতে যাওয়াটা কতটা কষ্টকর। সেজন্য আমি একজন সন্ন্যাসিনী কে বলে রেখেছি যে তোমার জন্য প্রতিদিন খাবারের ব্যবস্থা করবে। আশ্রম থেকে কয়েক মাইল দূরে তার বাড়িতে তুমি প্রতিদিন খাবার খেতে যাবে।"
তো সেই সন্ন্যাসী (রাজা) ভিক্ষা করতে যাওয়ার বদলে সে সন্ন্যাসিনীর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। যেতে যেতে সে ভাবতে লাগলো আজ থেকে তার আর পছন্দের খাবারগুলো কখনোই খাওয়া হবে না। খাবারগুলো কতই সুস্বাদু ছিল। কারণ, সন্ন্যাসী রা ভিক্ষা করে যে খাবার পায় তাই খায়। আর রাজা তো নিজ ইচ্ছায় সন্ন্যাসী হয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতে সে সন্ন্যাসিনীর বাড়িতে এসে পৌঁছায়। যেহেতু গৌতম বুদ্ধ পূর্ব থেকে সন্ন্যাসিনী কে বলে রেখেছিল, তাই সে খাবারের ব্যবস্থা করে রাখে। সন্ন্যাসিনী যখন খাবারগুলো নিয়ে রাজার সামনে পরিবেশন করে রাজা পুরোই অবাক হয়ে যায়। খাবার গুলো হচ্ছে তার সব পছন্দের। সে যা যা খেতে পছন্দ করে তাই তাই রান্না করা হয়েছে। প্রথমে সে একটু অবাক হলেও পরবর্তীতে ভাবতে লাগলো এটা হয়তো একটি মিরাকেল। পছন্দের খাবার গুলো যখন খেতে পারছে তখন আর সমস্যা কিসের। এ বলে সে তৃপ্তি সহকারে খাবার খেয়ে নিল।
খাবার খাওয়া শেষে ভাবতে লাগলো, রাজা থাকা অবস্থায় রাজমহলে খাবার শেষে বিশ্রাম নিতাম এখন আর সেই সৌভাগ্য আমার হবে না। এখন আমাকে এ প্রখর রোদের মধ্যে হেঁটে হেঁটে আশ্রমে যেতে হবে। পরবর্তীতে সে আবার ভাবল সে তো নিজের ইচ্ছাতে এসেছে, সন্ন্যাসী হয়েছে। তাহলে এ সব আজেবাজে চিন্তাভাবনা কেন করছে। রাজা যখন এসব ভাবছিলেন তখন সন্ন্যাসিনী বলে উঠলেন, আপনি খাবার শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তারপর আশ্রমে যান। এখন যদি যান তাহলে আপনার কষ্ট হবে যা আমার ভালো লাগবে না। আপনি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তারপর গেলে আমার খুব ভালো লাগবে। এই কথাগুলো শুনে সন্ন্যাসী ভাবলো আমি তো জোরে জোরে কিছু বলিনি, তাহলে সন্ন্যাসী নিজে কথাগুলো শুনলো কিভাবে। তাহলে কি ইনি মনের কথা পড়তে পারেন। পরবর্তীতে ভাবলেন, না না এটা কিভাবে সম্ভব। এটা হয়তো একটি কাকতালিয় ঘটনা। তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছেন আমি অতদূর থেকে অনেক কষ্ট করে এসেছি, খাবার খাওয়া শেষে এখন যেতে হয়তো কষ্ট হবে এই ভেবে আমাকে বিশ্রাম নিতে বলছেন। এরপর সন্ন্যাসিনী তার কুঠিরের একটি ফাঁকা জায়গায় খোলা আকাশের নিচে মাদুর পেতে দিল। সন্ন্যাসী সে মাদুরে শুয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো, কালকে পর্যন্ত আমার কাছে সুন্দর একটি রাজমহল ছিল। সে রাজমহলে সুন্দর একটি দামি খাটে আমি শুয়ে থাকতাম। আজ আমার সে দামী খাট, বিলাসী জীবন, রাজমহল কোন কিছুই নেই। এমনকি আজকে আমার মাথার উপর একটি ছায়াও নেই। আজকে আমি খোলা আকাশের নিচে মাটিতে শুয়ে আছি। সন্ন্যাসী যখন এসব ভাবছিলেন তখন সন্ন্যাসিনী বলে উঠলেন আপনি কেন বারবার এসব ভাবছেন। এরকম কেন চিন্তা করছেন। এখানে গৌতম বুদ্ধের চেয়ে বড় কোন ছায়া আর নেই, খোলা আকাশের মতো সুন্দর ছাদ কোথাও নেই, আর জমির মতো সুন্দর বিছানা কোথাও নেই। আপনি শুধু শুধু অতীতের কথা ভেবে দুঃখ পাবেন না।
এই কথাগুলো শোনার পর সন্ন্যাসী বিস্মিত হয়ে উঠে বসলেন। এবার আর তিনি বিষয়টিকে কাকতালীয় ভাবলেন না। তার মনে হতে লাগলো এই সন্ন্যাসিনী নিশ্চয়ই মনের কথা পড়তে পারে। সে সন্ন্যাসিনী কে জিজ্ঞেস করল আপনি কি মনের কথা পড়তে পারেন? আমার মনের মধ্যে কি চলছে, আমি কি ভাবছি আপনি কি সব জানতে পেরে যাচ্ছেন। সন্ন্যাসিনী একটু মুচকি হেসে বললেন, হ্যাঁ আমি সব বলতে পারি। সন্ন্যাসী বলল, কিভাবে কিভাবে আপনি অন্যের মনের কথা পড়তে পারেন? সন্ন্যাসিনী বললেন আমি এটা সাধনার দ্বারা অর্জন করেছি।সবার প্রথমে আমি ধ্যানের মধ্যে নিজের মনের মধ্যে চলা চিন্তা গুলোকে পর্যবেক্ষণ করতাম। তারপর একটা সময় পরে আমার মনে আর কোনো চিন্তা আসতো না। আমার মন একপ্রকার চিন্তা শূন্য অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছিল। এখন আমি আমার আশেপাশে থাকা অন্য মানুষদের মনের মধ্যে কি চিন্তা চলছে তা কিছুটা অনুভব করতে পারি এবং বলতে পারি।
এ কথাগুলো শোনার পর সন্ন্যাসীর চক্ষু বিস্ময়ে ভরে গেল। ভয় এবং লজ্জায় তার হাত-পা কাঁপতে শুরু করল। কারণ, তার সামনে থাকা সন্ন্যাসিনী ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী। তাকে নিয়ে তার মনে কয়েকবার খারাপ চিন্তা জাগ্রত হয়েছিল। সন্ন্যাসী ভাবতে লাগলো তার মানে তিনি সব জানতে পেরে গেছেন, তাকে কতই না খারাপ এবং বাজে ভাবছে। এসব চিন্তা করে সাথে সাথেই সন্ন্যাসিনীর গৃহ ত্যাগ করলেন। তিনি আশ্রমে ফিরে গৌতম বুদ্ধকে বললেন,আমি কাল থেকে আর ওই সন্ন্যাসিনীর বাড়িতে খাবার খেতে যেতে পারবো না।
গৌতম বুদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন, "তোমার কি ঐখানে কোন সমস্যা হয়েছে?"
সন্ন্যাসী বলল,না কোন সমস্যা হয়নি। উনি আমাকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছেন এবং আমার পছন্দের খাবারগুলো খাইয়েছেন। কিন্তু তারপরও আমি কাল থেকে উনার গৃহে খাবার খেতে যেতে পারবো না। দয়া করে আমাকে আর এ ব্যাপারে কিছু বলবেন না।
গৌতম বুদ্ধ বললেন,"আসল কারণ তো না জেনে আমি এভাবে তোমাকে ছেড়ে দিতে পারি না।"
এক প্রকার বাধ্য হয়েই সন্ন্যাসী সব কিছু বললেন। সে বলল ঐ সন্ন্যাসিনী মনের সব কথা পড়তে পারেন। আমি যা ভাবছি উনি তাই বলে দিতে পারেন। উনি একজন খুবই সুন্দর মহিলা। আমি না চাইতো ও আমার মধ্যে তাকে নিয়ে খারাপ চিন্তা উদিত হয়েছিল। এবার আপনি বলুন আমি ওনার সামনে কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াবো। উনি আমাকে কতই না খারাপ ভাবেছেন।
আরো পড়ুন: সফল হওয়ার আটটি জাপানি কৌশল
বুদ্ধ বললেন,"আমি কোন কারণ ছাড়াই তোমাকে ঐখানে পাঠাইনি। তোমাকে ঐখানে পাঠানোর পিছনে অবশ্যই একটি কারণ আছে। যতক্ষণ না সে উদ্দেশ্যটি পূরণ হচ্ছে ততদিন তোমাকে সেখানে যেতেই হবে। আমি বারণ না করা পর্যন্ত তোমাকে সেখানে যেতেই হবে। তবে এবার থেকে তুমি যখন যাবে তুমি নিজের মনের মধ্যে আশা প্রতিটা চিন্তাকে পর্যবেক্ষণ করবে ।প্রতিটা মুহূর্ত কি কি চিন্তা করছো সেগুলো খুব ধ্যানের সাথে পর্যবেক্ষণ করবে। সে চিন্তা গুলোকে আর আটকানোর চেষ্টা করবে না, সেগুলো কে চেপে রাখার চেষ্টা করবে না। এরকম ভাববে না যে নির্দিষ্ট কোন চিন্তা তোমার মধ্যে না আসে। চিন্তা গুলোকে মুক্তভাবে আসতে দিবে এবং যেতে দিবে। চিন্তাগুলোকে ধরে বসে থাকবে না।
তোমার কাজ হচ্ছে একটাই, মনের মধ্যে আশা চিন্তা গুলোকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা।"
পরবর্তীতে, সন্ন্যাসী ছতার নিজের মনের মধ্যে চলা চিন্তাভাবনা গুলো নিয়ে খুবই সচেতন হয়ে গেল। সন্ন্যাসী যেহেতু মনের মত থাকা চিন্তাগুলো কে পড়তে পারে। তাই সে প্রতিটা পদক্ষেপে নিজের মনের মধ্যে থাকা চিন্তা গুলো কে নিয়ে সচেতন হয়ে গেল। সে প্রতিটা পদক্ষেপ নেয় সচেতন হয়ে। সন্ন্যাসিনীর বাড়িতে প্রবেশ করে সচেতন হয়ে। এমনকি তার প্রতিটা নিশ্বাস সচেতন হয়ে নেয়। কিন্তু,আজকে তার সাথে একটু অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। সে যেহেতু প্রতিটা পদক্ষেপে তার মনের মধ্যে কি চিন্তা আসছে তা পর্যবেক্ষণ করছে। সে লক্ষ্য করল,এখন তাঁর মনের মধ্যে আর কোন চিন্তা চলছে না। সে যত দেখার চেষ্টা করল তার মনের মধ্যে কি চলছে ততোই দেখল সেখানে সবকিছু খালি কোন চিন্তাই নেই। সে সন্ন্যাসিনীর বাড়িতে গেল খাবার খেলো এবং মনের মধ্যে আসার প্রতিটি চিন্তাকে পর্যবেক্ষণ করলো। কিন্তু, আশ্চর্যজনকভাবে তার মনে সেদিন কোন চিন্তায় আসলো না। সেদিন সে খেয়ে, বিশ্রাম নিয়ে আশ্রমে ফেরত আসলো।
তারপর বুদ্ধকে বললেন, হে বুদ্ধ আমার সাথে আজ একটু অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। আপনার কথা মত আমি আমার মনের মধ্যে চলা প্রতিটি চিন্তা ভাবনাকে পূর্ণতার সাথে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলাম। আমি লক্ষ্য করলাম,আমার মনের মধ্যে সম্পূর্ণ খালি হয়ে গেল। কোন চিন্তা সেখানে উৎপন্ন হলো না। ফেরার সময়ের মাঝে দু-একবার সচেতন হয়ে চিন্তাকে পর্যবেক্ষণ করতে ভুলে গেছিলাম। তখন আমি খেয়াল করছিলাম আমার মনে অনেক চিন্তা কোথা থেকে যেন এসে গেছিল। কিন্তু, ঐখানে যতক্ষণ ছিলাম আর নিজের চিন্তাগুলোকে নিয়ে পূর্ণ সচেতন ছিলাম ততক্ষণ আবার মন একদম চিন্তা শূন্য ছিল।।
আরো পড়ুন: নিজেকে সুখী রাখার উপায়; গৌতম বুদ্ধের শিক্ষণীয় গল্প
গৌতম বুদ্ধ বললেন,"আমি ঠিক এই শিক্ষাটি দেওয়ার জন্য তোমাকে ঐখানে পাঠিয়েছিলাম। আমাদের মনের মধ্যে থাকা চিন্তা, দুঃখকে দূর করতে হলে আমাদের পূর্ণ সচেতনতার সাথে সেগুলোকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সেগুলো আটকে রাখার চেষ্টা করলেও হবে না,সেগুলো ধরে রাখার চেষ্টা করলেও হবে না। সেগুলো যেমন আসবে, যেমন যাবে সেভাবে আসতে দিতে যেতে হবে। আমরা যদি একাগ্রতার সাথে মনের মধ্যে আশা চিন্তাভাবনা গুলোকে পর্যবেক্ষণ করতে শিখে যায়, যখন যে কাজটি করছি সেটা যদি খুব সচেতনতার সাথে করি।তাহলে আমাদের মনের মধ্যে উঠা চিন্তার ঢেউ কমতে থাকবে আর একটা সময় পরে সেটা চিন্তা শূন্য পর্যায়ে পৌঁছাবে।
গল্প থেকে যে শিক্ষা পাই:
গৌতম বুদ্ধ এবং রাজার এই গল্প থেকে আমরা নিজের মনের মধ্যে চলা আজেবাজে খারাপ চিন্তা দূর করার একটা ব্যবহারিক সমাধান পায়। আমরা খেয়াল করলে দেখতে পাবো যে, আমাদের মনের মধ্যে যে চিন্তা ভাবনা গুলো আসে তা আমাদের অসচেতন অবস্থায় আছে। কিন্তু,আমাদের সামনের ব্যক্তিটি যদি আমাদের মনের মধ্যে চলা সব কিছু পড়তে পারে তাহলে কি আমরা এতটা অসচেতন থাকবো?
অবশ্যই না, তখন নিশ্চয়ই আমরা মনের মধ্যে কি চলছে সেটাকে খুব সচেতনতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করবো। আর এটাই হলো সমস্যার সমাধান।
যখন যে কাজটা করব সেটা পূর্ণ সচেতনতার সাথে পর্যবেক্ষণ করা। বর্তমানে, হয়তো সব সময় আমরা কি করছি সেটা গভীরভাবে সচেতনার সাথে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব না। কিন্তু, যখন আমাদের মনে পড়বে যে এটা করা উচিত, তখন আমরা এটা চেষ্টা করতে পারি। আমরা হয়তো ভুলে যাব ব্যাপারটা। কিন্তু, যখন আমাদের মনে পড়বে তখন আমরা এই মাইন্ড অবজারভেশন টা করতেই পারি। এই মাইন্ড অবজারভেশন আমাদের সকল খারাপ চিন্তা থেকে মুক্তি দিবে।
উপদেশ বাণী:
আমরা দিনের কিছুটা সময় ধ্যান বা মেডিটেশন করতে পারি। আর মডিটেশনের সময় আমাদের কাজ শুধুমাত্র আমাদের চিন্তাগুলোকে সচেতনার সাথে পর্যবেক্ষণ করা। মেডিটেশন মানে শুধু চিন্তাগুলোকে পর্যবেক্ষণ করা আর গভীরভাবে ভাবানো হয় না। চিন্তাগুলোকে স্বাধীনভাবে আসতে ও যেতে দেওয়া। আর আমরা যদি এটা নিয়মিত অভ্যাস করতে পারি তাহলে আমাদের মনের মধ্যে চলা চিন্তাভাবনা গুলো আস্তে আস্তে কমতে থাকবে আর আমরা আগে থেকে অনেক শান্তি অনুভব করব।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url